ঝিনাইদহঃ কালীগঞ্জ শহরের ভূষণ স্কুলপাড়ার ভবেশ দাসের বাড়িতে এখন শুধুই কান্নার রোল। এ পরিবারের বুকফাটা আহাজারি আর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে পুরো এলাকার বাতাস। বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন গৃহকর্ত্রী পারুল দাস। চেতনা ফিরলেই কাঁদছেন চিৎকার করে। শুক্রবার ভোরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন এই পরিবারের ৩ সদস্য। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া গৃহকর্তা ভবেশ দাসসহ আরও তিনজন। নিহতরা হলেন ভবেশের মেয়ে ঢাকা ইডেন কলেজের ছাত্রী কৃষ্ণা (২৫), পুত্রবধূ বর্ণা (৩০) ও বর্ণার শিশুপুত্র কৌশিক (৮)। আহত হয়েছেন ভবেশসহ ভাইবৌ অর্চনা ও অর্চনার ছেলে নৃশান্ত।সারা শরীরে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকা ভবেশ জানালেন, পেশায় মিষ্টির কারিগর তিনি। জ্যাঠাতো ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য দিনে মিষ্টি তৈরির কাজ সেরে বৃহস্পতিবার রাতে কালীগঞ্জ থেকে পরিবারের ছয় সদস্যসহ বাসে ওঠেন। কে জানত ফেরার পথে তার জন্য অপেক্ষা করছে হিমশীতল নিয়তি! আর ১৫ মিনিট পার হলেই তিনি পেঁৗছে যেতে পারতেন নিজবাড়ির আঙিনায়। সেটি আর হয়নি, একটি মুহূর্ত কেড়ে নিয়েছে কন্যা ও পরিবারের তিন সদস্যসহ ১১ আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ। অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি তার বাড়িতে এখন শোকের মাতম।ভবেশ দাসের বাড়ি যেন শ্মশানপুরী
ভবেশ জানান, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাসটি বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে উঠতেই প্রচ শব্দ। মনে হলো শূন্যের ওপর ভাসছি। পরে পাশেরডোবায় নিজেকে আবিষ্কার করি। তখনও জানতাম না আমার কলিজারা (নিহত স্বজন) আর নেই।একই কথা জানান, এই পরিবারের আহত আরেক সদস্য অর্চনা। তিনি বলেন, উদ্ধারকর্মীরা যখন তাকে গাড়িতে ওঠান, তখন দেখি ট্রেনটি বাসটিকে দুমড়ে-মুচড়ে অনেকদূর নিয়ে গেছে। বাসের জানালা ও ভাঙাচোরা ফাঁকফোকর দিয়ে মানুষ ছিটকে পড়েছে ট্রেনলাইনের ধারে। যারা বাসের মাঝামাঝি স্থানে ছিলেন তারাই বেশিরভাগ হতাহত হয়েছেন। পরিবারের অন্যদের খোঁজ করার আগেই জ্ঞান হারান তিনি।
বিলাপ আর কান্নার মাঝে নিহত কৃষ্ণার মা পারুল দাস বললেন, ও (কৃষ্ণা) এ বছর মাস্টার্স পাস করেছে। আসা ছিল শিক্ষিত মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দেবেন। তার আগেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সেই স্বপ্ন।ঘটনার আকস্মিকতায় শোকবিহবল প্রতিবেশীরাও। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তারা ছুটে আসেন এই বাড়িতে। প্রতিবেশী শহিদুল জানান, এলাকার শান্ত মানুষ হিসেবে পরিচিত এই পরিবারের লোকজন। ফলে তাদের এমন মৃত্যু ব্যথিত করেছে তাদের সবাইকে।বার বার মূর্ছা যাচ্ছে নববধূ জোসনা সারাজীবন দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। হয়তো সবার সঙ্গে মিলেমিশে স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপনের চেষ্টা করব, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে ১১ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। এভাবেই কথাগুলো জানালেন নববধূ জোসনা রানী ওরফে সুন্দরী।
শুক্রবার রাতে কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার সাকো মথনপুর গ্রামের সুবল বিশ্বাসের মেয়ে স্কুলশিক্ষিকা জোসনা রানীর বিয়ে হয় ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাপস কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। তাপস একই গ্রামের মৃত রণজিত কুমার বিশ্বাসের ছেলে। বিয়ে শেষে যাত্রীবাহী বাস বারবাজার মাছ বাজারের রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনায় কবলে পড়ে।নববধূ জোসনা জানান, আহত ও নিহতরা আজ সবাই আমার সঙ্গে দেখা করতেন। সবাই পরিচিত হতেন, কতই না আনন্দ করতেন। অথচ তাদের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই চলে গেলেন না- ফেরার দেশে।