নিজের সাথেই নিত্য চলা আমাদের, অন্যের সাথে নৈমিত্তিক। এই চলতে ফিরতে যাপিত জীবনের কতটা খবরই বা আমরা রাখতে পারি? বা “জীবনটা কেমন করে চলছে” তার কতখানিই বা বোঝার সামর্থ্য রয়েছে আমাদের? দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা কিছু করি তার সিংহভাগই আমাদের অবচেতন মন নেপথ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ‘নিয়ন্ত্রণ’ এতটাই নীরবে সংগঠিত হয় যে, ‘চেতন-মন’ সেটা বুঝতেও পারে না। সচেতন-মনটা শুধুই নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে, -‘আমি এমন কেন করি’? এই চেতন-অবচেতন মনের কারসাজি নিয়েই স্মৃতি হাতড়াবো আজ।
আমার স্ত্রী’র রান্নার হাত ভাল। মিস্টান্ন, বিরিয়ানী, কোরমা, গো-মাংস ইত্যাদি সব রান্নায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সেদিন তিনি পায়েস রেঁধেছেন, ঘন দুধে-আঁটা খেজুরের গুড়ের পায়েস। বাটি ভর্তি করে ফ্রিজে রেখেছেন। তো রাতের আহার শেষে মিষ্টি কিছু একটা খাবো বলে ফ্রিজ খুলে দেখছিলাম, কি খাওয়া যায়। দেখি ফ্রিজের একটি তাক জুড়ে শুধুই মিষ্টি খাবার রাখা। সদ্য রাঁধা পায়েস, একটি বাটি ভর্তি দুধ-কুলি পিঠা, এ ছাড়াও বাজার থেকে কেনা রস-মালাই, ছনপাঁপড়ী ও চমচম ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রাখা। আমার বড় বড় চোখ দুটো “পায়েস থেকে চমচম” পর্যন্ত সব মিস্টির উপর দিয়ে দ্রুত বুলিয়ে গেল। কিন্তু মনে ধরলো না কোনটিই। আমি ডিপ ফ্রিজ খুলে একখন্ড পাটালি গুড় তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলাম।
আর যাই কোথা! একেবারে হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠলেন আমার স্ত্রী। গেয়ো ভুত কোথাকার! ঘরে এত মিষ্টি-পায়েস থাকতে তুমি কিনা গুড় খাচ্ছো? আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলাম খানিকক্ষণ। একথা সেকথা বলে তাঁকে গুড়ের মাহাত্ব্য বোঝানোর চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু কোন ফল লাভ হলো না। আমি যে ‘গেও ভুত’ তাঁর পূর্বেকার সেই সিদ্ধান্তটি আরো খানিকটা পোক্ত হলো মাত্র। গাঁয়ে জন্মেছি যখন, তখন ‘গেও ভুত’ হতে বিশেষ আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিজেও ভাবছিলাম যে, এত পদের সুস্বাদু মিষ্টি-মিষ্টান্ন থাকতে আমিই বা কেন গুড় খেতে গেলাম? কারণটি বোধকরি মনস্তাত্বিক, হয়তো শৈশবের কিছু ঘটনা আমার অবচেতন মনকে ঐ মুহুর্তে প্রভাবিত করেছে।
আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে, দাদির বাড়িতে। একেবারে অজপাড়া গাঁ। সেই সময়ে আমাদের বাড়ি থেকে নিকটবর্তী মিষ্টির দোকানটি ছিলো অন্তত পাঁচ মাইল দুরবর্তী। বাড়িতে কালেভদ্রে মিস্টি আনা হতো। তাও তো সেই গুড়ের সন্দেশ, জিলাপি আর সাজ বাতাসা, -ওই পর্যন্তই। তবে বাড়িতে দাদি প্রচুর গুড় কিনে রাখতেন। খেজুরের গুড়, আখের গুড়, তাল গুড়, পাটালি গুড়, ঝোলাগুড়, দানাপড়া গুড়, নারকেলি গুড়, -ইত্যাদি আরো কত রকমারি সব গুড়ের বাহার। গ্রামের ৩/৪ জন গুড়ের ব্যাপারি ফরিদপুর অঞ্চল থেকে পাইকারি দামে গুড় কিনে এনে এলাকায় খুচরা বিক্রি করতো। আমার দাদি তাদের বাঁধা খরিদ্দার। তাঁর খাটের নিচের মাটির হাঁড়িগুলো নানান রকমের সব গুড় দিয়ে ভর্তি করে থরে থরে সাজানো থাকতো। আর ঐ গুড়ের হাঁড়িগুলো আমাদের জন্য সব সময় উন্মুক্ত ছিলো। আমরা চাচাতো-ফুফাতো ভাই বোনেরা মোট ১২/১৫ জন, যার যখন খুশি দৌঁড়ে গিয়ে দুহাতের মুঠি ভরে যখন যতটা মন চেয়েছে গুড় খেতে পেয়েছি।
দাদিকে কখনও গুড় খেতে দেখিনি। কিন্তু আমাদের খাওয়া দেখে তিনি বড়ই আনন্দ পেতেন। শৈশবের সেই গুড়ের স্বাদ হয়তো আমার অস্থি মজ্জায় আজও মিশে আছে। অবচেতন মনটি মিষ্টি বলতে প্রথমে গুড়ই বোঝে। তাই হয়তো আজকের আধুনিক নগর জীবনের বাসিন্দা আমি ভেতরে ভেতরে রসমালাই-পায়েস থেকে গুড়ের মিষ্টতাই বেশি পছন্দ করি!
এই গুড় প্রসংগে পাঠকদের ছোট্ট আরেকটি তথ্য জানাতে খুব লোভ হচ্ছে। আমার মেঝ ফুফা বনেদি মিয়া বংশের উত্তরাধিকার, নীল রক্ত তাঁর ধমনীতে প্রবাহমান। আচার-ব্যবহার, চলনে-বলনে বনেদি মেজাজ সুস্পষ্ট। ভোজন-বিলাস তাঁর বাড়াবাড়ি রকমের। পাঠক নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছেন যে, গুড় প্রধানত দুই রকমের, (১) পাটালি গুড় অর্থাৎ শুকনা গুড়, আর (২) ঝোলা গুড় বা তরল গুড়। তো আমার ফুফা পাটালি গুড় খেয়ে কখনও তৃপ্ত হতেন না। তাঁর কাছে ঐ শুকনো পাটালি গুড় কখনও যথেষ্ঠ মিস্টি বলে মনে হতো না। তিনি সব সময়ই পাটালি গুড়ের খন্ডটি ঝোলা গুড়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতেন! ভোজন রসিক আর কাকে বলে! আরেকটি ঘটনাক্রম বলে শেষ করবো।
আমাদের একমাত্র সন্তান এখন পরিপূর্ণ যুবক। ইউনিভার্সিটি পাস দিয়ে টরন্টোর ডাউন টাউনে চাকুরি করে। সেদিন আমার জন্য সে একখানা তোয়ালে কিনে নিয়ে এলো বাড়িতে। সেটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, আর গামছা নয়; এখন থেকে শাওয়ার করে এটা দিয়ে গা মুছবে। বললাম না না বাবা, সেটি তো হবে না! গামছা ছাড়া আমার গায়ের পানি মুছবে না। এবার মা-ছেলের অভিন্ন সুর! তোমার ‘গেঁও স্বভাব’টা বদলাওতো আব্বু। আমি বড়সড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে তাকে বললাম, আর কবে বদলাবো বাবা! মনে মনে বললাম, কেনই বা বদলাবো!
তিনজনের বসবাস আমাদের বাড়িতে। ছেলের দুখানা তোয়ালে, তার মায়ের দুখানা। আমার সম্বল একখানা গামছা। বাংলাদেশ থেকে টরন্টো আসার লোক পেলেই আমার বোনেরা আমার জন্য গামছা আর লুঙ্গি কিনে পাঠায়। বাড়িতে ওদের মা-ছেলের তোয়ালে নিয়ে ঠোকাঠুকি লেগেই আছে। আম্মু তুমি কি আমার তোয়ালে ধরেছিলে? না, কখনোই না, আমি কেন তোর তোয়ালে ধরতে যাবো? উচ্চস্বরে মা-ছেলের এমনতর সংলাপ বাড়িতে প্রায়ই শোনা যায়। অর্থাৎ কেউ কারো তোয়ালে স্পর্শ করলো কিনা (ব্যবহারতো অনেক দূরাগত ব্যাপার) তাই নিয়ে বিতন্ডা! ওদের হাবভাবে মনে হয়, কেউ কারো তোয়ালে ধরলেই তৎক্ষণাৎ ওরা নানা রকমের ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে হয়তো মারাই যাবে!
তো এই সুযোগে আমার গামছা-প্রীতির পূর্বসূত্রটি একটু বলে ফেলি। দাদির বাড়িতে চাচা, ফুফা, চাচাতো, ফুফাতো ভাই-আত্মীয় মিলে সব সময়ই জনাবিশেক পুরুষ মানুষের বসবাস। বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে আমরা প্রতিদিনই সাঁতার কেটে গোসল সারি। এই জনাবিশেক পুরুষের ব্যবহারের জন্য সাকুল্যে গামছা মোট তিনখানা। বেলা বারোটা নাগাদ পালা করে গোসল করা শুরু হয়, শেষ হতে সেই বিকাল তিনটা। কারণ গামছা মাত্র তিনখানা হওয়ায় একসাথে তিনজনের বেশি পুকুরে নামা যায় না। তো এই যে তিনখানা গামছা বছরের পর বছর আমরা সকলে মিলে ব্যবহার করলাম, তাতে করে আমাদের কারো কিন্তু কোনদিন কোন অভিযোগ ছিলো না বা কোন হাইজীনিক (স্বাস্থ্য বিষয়ক) সমস্যাও হয়নি। এ নিবন্ধের শুরুতে বলছিলাম অবচেতন মনের ‘নিয়ন্ত্রকের’ ভুমিকার কথা। শৈশবের সেই গামছা ব্যবহার-অভ্যাসের কারণেই হয়তো আজ দামী তোয়ালে দিয়ে আমার গায়ের পানি মোছায় আমি আনন্দ পাই না। মনে হয় গা শুকালো না। অথচ সস্তা গামছাখানি কত সহজেই আমার গায়ের পানি শুকিয়ে দেয়।
আজকে অতি আধুনিক এক নগর জীবনের নাগরিক আমি। কিন্তু শৈশব-কৈশোরের অভ্যাসগুলো কি আমি ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি? কাজ শেষে ঘরে ফিরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে টাইয়ের নট খুলে লুঙ্গি পরতে না পারলে অস্বস্তির ঘামে গা ভিজে যায়। ফিলটার্ড ওয়াটার অথবা ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা বোতলের পানিতে আমার তৃষ্ণা মেটে না! বড় সাইজের গেলাস ভরে ট্যাপের পানি ঢকঢক করে গিললেই যেন বুকটা জুড়ায়। বাথরুমে গিয়ে মলমূত্র ত্যাগের পর টিসু পেপারের ব্যবহার আমার কাছে অতি অস্বস্তির কাজ বলে বিবেচিত। এ কাজের জন্য দেশ থেকে ‘বদনা’ নিয়ে এসেছি। জীবনের প্রয়োজনে প্রতিদিন গাড়ি চালাচ্ছি বটে, কিন্তু গ্রীস্মের দিনগুলোতে টরন্টোর রাস্তায় বাইসাইকেল চালানোর সুখ আমাকে কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
আজ এই মধ্য বয়সে প্রতিদিনের অভ্যাসে আমি যা কিছুই করি সবই যেন সেই শৈশব কৈশোর থেকে অনুরণিত। তখন যা যা ভালবাসতাম, আমি আজও ঠিক তাইই ভালোবাসি। তখন যা কিছু করতাম, আমি আজও তাই তাইই করতে চাই। আমার মধ্যে আজও যেন সেই কৈশোরের অভ্যাসগুলোই আকুলি-বিকুলি করে। হে মোর অজেয় কৈশোর তোমার জয় হোক। আমার ভেতরের ‘গেঁও ভুতটি’ জীবন চলার বাকি পথটুকুতে নিত্য সংগী হোক!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র অন্যতম নির্বাহী কর্মী)