|
নিউজটি পড়া হয়েছে
৬৩১
বার
অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ সুতার অভাবে
আনিসুজ্জামান
ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক হারিয়ে যেতে বসেছে। রেশম সুতার অভাবে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি মালিকানার রেশম কারখানা। এছাড়া একমাত্র সরকারি রেশম কারখানার চার শতাধিক বেকার শ্রমিক ১১ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে ক'টি চালু থাকলেও বিশ্ববাজারে অব্যাহত রেশম সুতার মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেগুলোও যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
বাংলাদেশ রেশম বোর্ড যে পরিমাণ রেশম সুতা উত্পাদন করে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে রাজশাহীর রেশম ব্যবসায়ীরা জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কাজাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে রেশম সুতা আমদানি করে দীর্ঘদিন চাহিদা মিটিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ দেশ রেশম সুতা রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বর্তমানে চীনের রেশম সুতা আমদানি প্রায় বন্ধ।
রেশম নগরী হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর বিসিক শিল্প এলাকায় দু'বছর আগেও ছোট-বড় মিলিয়ে ৭২টি রেশম কারখানা ছিল। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রেশম সুতার অভাবে। অবশিষ্ট কারখানার মধ্যে আরো কয়েকটি বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
রাজশাহীর 'সপুরা সিল্ক মিলসে'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোঃ সদর আলী জানান, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্রতিকেজি রেশম সুতা ৫ হাজার ৮০০ থেকে ৬ হাজার টাকার অধিক দামে কিনতে হচ্ছে। একইসাথে প্রতিকেজি দেশীয় সুতার দাম সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। অবাধে চোরাই পথে সুতা আমদানির কারণে দেশীয় রেশম সুতার বাজার এখন ধ্বংসের মুখে।
রেশম ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার রেশম বোর্ডের সহযোগিতায় ২৩টি রেশম পল্লীর মাধ্যমে সুতা সংগ্রহ, কুপন তৈরি ও সুতা উত্পাদনের প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তবে কবে নাগাদ সরকারের এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অনেক ব্যবসায়ীই সংশয় প্রকাশ করেছেন। রাজশাহীর রেশম শিল্প মালিকরা জানান, বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চাষীদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি প্রয়োগ, চাষী পর্যায়ে গুটি বিক্রির মাধ্যমে আগামী দু'বছরের মধ্যে দেশের চাহিদামতো সুতা উত্পাদন করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
দেশীয় রেশম চাষীরা সুযোগ-সুবিধার অভাবে রেশম গুটি উত্পাদন করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে প্রান্তিক চাষীরা অপর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা ও সরকারের অবহেলাকে দায়ী করেন। বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও রেশমের সমস্যাগুলোর সত্যতা স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, রেশমের গুটি ও সুতার অভাবে ব্যক্তি মালিকানার কারখানা বন্ধে রেশম কাপড়ের উত্পাদন হুমকির মুখে রয়েছে।
রাজশাহী রেশম কারখানা লিজ দেয়া হচ্ছে ১১ বছর ধরে বন্ধ রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম কারখানা লিজ দেয়া হচ্ছে। এ জন্য প্রাইভেটাইজেশন কমিশন টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মনোতোষ ধর সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে যৌথভাবে রাজশাহী রেশম কারখানা চালুর জন্য অসংখ্যবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত উদ্যোক্তার অভাবে তা সফল হয়নি। এরপর কারখানাটি বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। সে অনুযায়ী প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মাধ্যমে কারখানাটি লিজ দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্নের পথে রয়েছে। এ ব্যাপারে রেশম বোর্ডের প্রধান উত্পাদন ব্যবস্থাপক ও বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোর্তজা রেজা বলেন, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনকে রেশম কারখানার সার্বিক সম্পদের হিসাব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা কারখানাটি লিজের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। কাঙ্ক্ষিত উদ্যোক্তা পেলে এবারই প্রাইভেটাইজেশন কমিশন রাজশাহী রেশম কারখানাটি লিজ দিতে পারবে। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের একজন উপ-পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী রেশম কারখানায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
চার শতাধিক শ্রমিকের মানবেতর জীবন বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজশাহীর সরকারি-বেসরকারি রেশম কারখানার চার শতাধিক বেকার শ্রমিক-কর্মচারী ১১ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদের অধিকাংশই আবার নারী। ইতোমধ্যে অনেকে মারাও গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত টার্মে স্থানীয় সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা এবং সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন অসংখ্যবার রাজশাহী রেশম কারখানা চালুর আশ্বাস দিয়েছেন। রেশম কারখানা চালুর বিষয়টি উভয়ের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সংসদীয় কমিটি বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী সফরে এসে রেশম কারখানা চালুর আশ্বাস দিয়েছেন।
রাজশাহী রেশম কারখানার যত লোকসান ১৯৬১ সালে ৪৭১ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিয়ে যাত্রা শুরুর পর রাজশাহী রেশম কারখানাটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত লাভজনক ছিল। ১৯৭৮ সালে কারখানাটি রেশম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার পর লোকসানের পালা শুরু। এরপর আর কারখানাটি লাভের মুখ দেখেনি। অব্যাহত লোকসানের অজুহাত তুলে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর রাজশাহী রেশম কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০০১ সালে প্রায় ৬ কোটি টাকার বিএমআরআই মেশিন ক্রয় করা হয়। বন্ধের আগে কারখানার ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ ছিল। ২০০৬ সালে কারখানাটি বেসরকারিকরণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণেই অন্যান্য সরকারি শিল্পের মতই রাজশাহী রেশম কারখানা বছরের পর বছর লোকসান দিয়েছে। একইভাবে সিল্কের উন্নয়নে সরকার ও রেশম বোর্ড মাঝেমধ্যে কিছু 'ভাল উদ্যোগে'র কথা শোনালেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। ১৯৯২ সালে রাজশাহীতে 'রেশম শিল্প নগরী' স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দ হলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
|
|
|
|